ট্রাম্পের শুল্ক আটকে গেল আদালতে
আপলোড সময় :
৩০-০৫-২০২৫ ১১:০৩:১৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
৩০-০৫-২০২৫ ১১:০৩:১৪ পূর্বাহ্ন
বিভিন্ন দেশের ওপর ব্যাপকহারের শুল্ক আরোপের যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেটি আটকে দিয়েছে দেশটির এক আদালত। আদালতের এই রায়কে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির ওপর একটি বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে। নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়ে দিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপ আইনি ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানবিরুদ্ধ। এই রায়ের পর মার্কিন ও বিশ্ব অর্থনীতির নানা স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রায়টি শুধু ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির ওপরই নয়, বরং ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্টদের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ক্ষমতার ওপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
এ পর্বে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে একটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে আসছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি ‘জরুরি অবস্থা’। এই যুক্তিতে তিনি আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (আইইইপিএ) ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ শুরু করেন। তিনি প্রথমে চীন, পরে কানাডা, মেক্সিকো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক বসান। ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’ নামে পরিচিত এই নীতির আওতায় অনেক পণ্যের ওপর ১০ থেকে ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়।
আদালতের তিন বিচারকের একটি প্যানেল দীর্ঘ শুনানি শেষে জানায়, আইইইপিএ প্রেসিডেন্টকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির’ প্রেক্ষাপটে জরুরি পদক্ষেপ নিতে অনুমতি দিলেও এর আওতায় প্রেসিডেন্টের বিশ্বব্যাপী শুল্ক আরোপের অধিকার নেই। রায়ে বলা হয়, ‘এই শুল্ক আদেশগুলো প্রেসিডেন্টকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে দেওয়া আইনি ক্ষমতার আওতাভুক্ত নয়।’
বিচারকরা আরও বলেন, ‘শুল্কগুলো অকার্যকর বা অনৈতিক হওয়ার জন্য অবৈধ নয়। বরং এগুলো আইনের আওতায় অনুমোদিত নয় বলেই অবৈধ।’ একই সঙ্গে বিচারকরা ট্রাম্পের শুল্ক আদেশকে ‘বিশ্বব্যাপী ও প্রতিশোধমূলক’ বলে উল্লেখ করেন। যা আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উপায় হতে পারে না।
রায়ের প্রেক্ষিতে যে দুটি প্রধান মামলা এসেছে, তার একটি করেছে নিউইয়র্কের একটি ছোট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ পাঁচটি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের নেতৃত্বে ১২টি রাজ্য। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ ছিল, শুল্কের কারণে তাদের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে, ফলে তারা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। নিউইয়র্কের এক আমদানিকারক বলেন, ‘এই শুল্ক আমাদের ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা কার্যত দেউলিয়া হওয়ার মুখে।’ রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, আইইইপিএ প্রেসিডেন্টকে এমন ধরনের শুল্ক আরোপের এখতিয়ার দেয় না। বিশেষ করে যখন সেই ঘাটতি গত ৪৯ বছর ধরে বিদ্যমান এবং এর কোনো আকস্মিক বিপদ নেই।
তবে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাম্প প্রশাসন তা আপিল করে। হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি কুশ দেশাই এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কোনো জাতীয় জরুরি অবস্থা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নির্ধারণ করার অধিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের, আদালতের নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকান স্বার্থ রক্ষায় প্রতিটি সংবিধানসম্মত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। আমেরিকান উৎপাদন ও চাকরি ফিরিয়ে আনাই তার অঙ্গীকার।’ অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান নীতিনির্ধারক স্টিফেন মিলার সামাজিকমাধ্যমে একে ‘বিচার বিভাগের অভ্যুত্থান’ বলে উল্লেখ করেন। তবে ট্রাম্প নিজে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি, বরং ট্রুথ সোশ্যালে অন্য একটি মামলার জয় নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।
রায়ের পরই বিশ্ববাজারে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ডলার শক্তিশালী হয় ইউরো, ইয়েন ও সুইস ফ্রাঁর বিপরীতে। জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক দেড় শতাংশ বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স ২০০ সূচকেও ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। ইউরোপীয় বাজারেও ইতিবাচক সাড়া মেলে। জার্মানির ড্যাক্স সূচক শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে যায়, ফ্রান্সের সিএসি ৪০ ও যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচকেও উল্লম্ফন দেখা যায়। ওয়াল স্ট্রিটে স্টক ফিউচারে মূল্যবৃদ্ধির আভাস পাওয়া যায়।
বিশ্বখ্যাত ব্যাংক ডয়েচে ব্যাংকের কৌশলবিদ জিম রিড বলেন, ‘যদি এই রায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বহাল থাকে, তা হলে প্রেসিডেন্টদের পক্ষে আইইইপিএ ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাদের ২৩২ ধারা বা অন্যান্য আইন ব্যবহার করতে হবে, যা তুলনামূলকভাবে সময়সাপেক্ষ ও আইনি জটিলতায় ভরা।’
গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষকরা বলেন, ‘রায়টি ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক কৌশলে আঘাত হেনেছে বটে, তবে তার কাছে এখনও কিছু আইনি পথ খোলা রয়েছে।’ তবে এসব বিকল্প ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নে অনেক সময়, তদন্ত ও কংগ্রেসের পরোক্ষ সহায়তা প্রয়োজন, যা রাজনৈতিকভাবে সবসময় সম্ভব নয়। বর্তমানে এই আইনি লড়াই ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল সার্কিট কোর্ট অব আপিলসে চলবে। সেখান থেকে প্রয়োজনে এটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যে শুল্কগুলো অন্য আইনের আওতায় এসেছে- যেমন ধাতব শিল্পে (স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম) সেগুলো এখনও বহাল রয়েছে। কারণ সেগুলো ১৯৬২ সালের ২৩২ ধারা অনুযায়ী ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ দোহাই দিয়ে আরোপ করা হয়েছিল।
আদালতের এই রায় মার্কিন রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে। প্রেসিডেন্টের হাতে থাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার ওপর এই রায় এক ধরনের আইনি রক্ষণ তৈরি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার শুল্কনীতির মাধ্যমে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে বাড়াতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জও জানিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের মতে, এমন মৌলিক সিদ্ধান্ত কেবল প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশিতে হওয়া উচিত নয়, বরং সেটি হতে হবে আইনের পরিপন্থী এবং কংগ্রেসীয় তত্ত্বাবধানে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এই রায় মার্কিন সংবিধানের ভারসাম্য রক্ষার এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে, যেখানে আদালত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। এখন অপেক্ষা, আপিল আদালত এবং শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেয়। তার ওপর নির্ভর করবে, ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে কতটা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স